1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভোটের মালদহে এখনো নায়ক গনি খানই

গৌতম হোড় মালদহ | স্যমন্তক ঘোষ মালদহ
২ মে ২০২৪

সশরীরে নেই ঠিকই, কিন্তু মালদহের ভোট গনি-ময়। তাকে মনে রেখে মানুষ এখনো ভোট দেন।

https://p.dw.com/p/4fPQh
মালদহের চরে ভোটের পোস্টার।
ভোটের মালদহে এখনো গনি খান চৌধুরী আগের মতোই প্রাসঙ্গিক। ছবি: Goutam Hore/DW

পঞ্চানন্দপুরে গঙ্গার ঘাটের কাছে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে হাশেম শেখ বললেন, ''ভুলে যাবেন না, এটা গনি খান চৌধুরীর মালদহ। লোকসভা ভোটে আমরা কি আর অন্য কাউকে ভোট দিতে পারি নাকি? তার পরিবারের মানুষ লড়ছেন, ভোটটা তাই হাতেই যাবে।''

কথাটা শুনে আপনার অবাক লাগতে পারে। মনে হতে পারে, যে গনি খান চৌধুরী ২০০৬ সালে মারা গেছেন, তার ১৬ বছর পরেও কী করে তার নামে মানুষ ভোট দিতে পারে?

কিন্তু মালদহের মানুষকে দয়া করে এই প্রশ্নটি করবেন না। কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, তৃণমূল হোক বা সিপিএম সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, গনি খান চৌধুরী না থাকলে মালদহ এই চেহারা পেত না। মালদহের এত মানুষ সরকারি চাকরি, বিশেষ করে কয়লা দপ্তরে ও  রেলের চাকরি পেতেন না। এই যে গনি খান মারা যাওয়ার পর টানা চারবার তার ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী জিতলেন, সেটাও তো একমাত্র গনি খান চৌধুরীর সৌজন্যে। মৌসম নুর থেকে শুরু করে ঈশা খান চৌধুরী পর্যন্ত তার পরিবারের মানুষরা যে সাংসদ-বিধায়ক হতে পারছেন, সেটাও তো তারই কল্যাণে।

মালদহের জন্য এমন কী করেছেন গনি খান, যার জন্য এখনো তাকে এমনভাবে মনে রেখেছে মানুষ। চিত্তরঞ্জন বাজারে মালদহের বিখ্যাত আমসত্ত্ব ও আম কাসুন্দি বিক্রি করেন সনাতন দাস। বছর পঁয়তাল্লিশের মানুষটি বললেন, গনি খান যখন রেলমন্ত্রী তখন যারা তার কাছে গিয়ে চাকরি চেয়েছে, সবাইকে দিয়েছেন। জাতি, ধর্ম, দল কোনো কিছু বাছাবাছি করেননি। মালদহের যুবক মানেই চাকরি। সরাসরি রেলে দিতে না পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থায় দিয়েছেন। কয়লা বা অন্য দপ্তরের যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখনো দিয়েছেন। তাকে মনে রাখবে না মালদহ! এই যে মালদহে এতবড় স্টেশন তা কার দান? শুধু মালদহ কেন, কলকাতার চক্র, মেট্রো, উল্টোডাঙ্গা স্টেশন থেকে শুরু করে অনেক কাজেই তো গনি খানের অবদান।

মালদহের চরে বাঁধা আছে নৌকা। ফসল আসছে ট্রাক্টরে। ফসল তোলা হবে নৌকায়।
মালদহে ভাঙনের পর তৈরি হয়েছে চর। এখানে বসবাসকারী মানুষের ভোটাধিকার আছে। ছবি: Goutam Hore/DW

তাকে নিয়ে তাই মালদহ গর্ব করে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে। পরপর আটবার তাকে সংসদে পাঠিয়েছেন এখানকার মানুষ। তার আগে বিধানসভায় পাঠিয়েছেন। এখন তার ভাই-ভাইপোদের পাঠাচ্ছে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মালদহ শাসন করেছেন গনি খান। মৃত্যুর পরে এখনো লোকসভা, বিধানসভার ভোটে গনি-শাসন অব্যাহত। সাধারণ মানুষের জন্য প্রাণ ঢেলে কাজ করলে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে, মানুষ যে তাদের এভাবেই মাথায় তুলে রেখে দেয়, তা আর কবে বুঝবেন রাজনীতিকরা?

এবার বারাণসী, অযোধ্যা, আসাম, কাশ্মীর, দিল্লি যেখানেই ঘুরেছি, দুইটি বিষয় সমানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। এক, জিনিসের দাম মাত্রাছাড়া জায়গায় চলে গেছে। দুই, চাকরি নেই। আমেঠির চায়ের ঠেকে এক যুবক প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ১৩ টাকা কেজি দরে চিনি দেবেন বলেছিলেন, তার কী হলো? প্রতিবছর কোটি কোটি চাকরি হবে বলেছিলেন, তারও দেখা নেই কেন? বারাণসীর ঘাট থেকে বরাক নদীর তির পর্যন্ত সর্বত্র ওই যুবকের কথার প্রতিধ্বনি শুনেছি। এখনকার মালদহে আরেকটি বড় সমস্যা আছে। গঙ্গায় ভাঙনের সমস্যা। গনি খান নেই, তাই সরকারি স্তরে শুধু প্রতিশ্রুতি ও কাজ দেখানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নেই বলে মনে করেন মালদহের মানুষ।

এখনো তাই বড় বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন কোতয়ালির সেই মানুষটি, যিনি একটা চিরকূটে লিখে দিলেই চাকরি হয়ে যেত। গঙ্গাভাঙনের মালদহে, চাকরিপ্রার্থীর মালদহে তাই এই হাহুতাশ শোনা যায়, যদি গনি খান থাকতেন। 

ফলে গনিকে এড়িয়ে মালদহে এখনো রাজনীতি হচ্ছে না।

আবার পঞ্চানন্দপুরে হাশেমের কাছে ফিরে যাই। তার সোজাসাপ্টা মন্তব্য, ''বিধানসভায় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছি, কিন্তু লোকসভায় ওদের দেব না। গনির পরিবারকেই দেব। এই লড়াই আলাদা।'' পাশে বসা আরো কয়েকজন তাকে একবাক্যে সমর্থন করলেন।

মালদহের চরের ছবি। এখানেও ভোটে দলের পতাকা লাগানো হয়েছে।
মালদহের চরের জীবনও অনিশ্চয়তায় ভরা। এই চরও বর্যায় ভাঙনের মুখে পড়ে। ছবি: Goutam Hore/DW

কিন্তু এই বিভাজনের যুগে, এই মেরুকরণের রাজনীতির সামনে দাঁড়িয়ে অনেক হিসাবই তো বদলে যায়। একদিন আগেই মালদহে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রোড শো করেছেন। জনসভা করেছেন। সেখানে বলেছেন, ''বিধানসভায় আপনারা আমাদের দুই হাত ভরে দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু  তৃণমূলের জন্মের পর থেকে , আজ পর্যন্ত মালদহ জেলার দুইটি লোকসভ আসন আমরা কোনোদিন পাইনি। এবার কি বদলানো যায় না? এবারও কি আমাদের আপনারা মালদহ থেকে আসন দেবেন না?''

মমতার উদ্বেগের কারণ সহজবোধ্য। মুসলিম সংখ্যাধিক্য়ের দুই জেলায় যদি তৃণমূল ভালো ফল না করে, যদি কংগ্রেস আবার সেখানে আসন জেতে, তাহলে তা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুখকর হবে না। তার উপর একের পর এক সাম্প্রতিক দুর্নীতির অভিযোগ, প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়া, সবকিছরই তো একটা প্রভাব রয়েছে।  শাহনওয়াজও বলেছেন, গনি খান হচ্ছেন আধুনিক মালদহের আইকন। তিনি অনেক কিছু করেছেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আর আর কিছু হয়নি। 

সমস্যা বিজেপি-রও কম নয়। তাদের প্রার্থীকে তো  দলের নেতৃত্বের একাংশ মেনে নিতে না পেরে বসে গেছেন। সেই  বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, ''গনি খান মালদহের জন্য প্রচুর করেছেন। কিন্তু তার পরিবারের মানুষ কিছু করেনি। মানুষ তাদের ভোট দিয়ে পাঠালেও তারা আশাভঙ্গ করেছেন।''

তাই যিনিই জিতুন, গনি খানকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। এখনো দক্ষিণ মালদহের রাজনীতিতে তিনিই নায়ক। রাহুল নন, সোনিয়া নন, অধীর নন, মালদহ এখনো গনি খানেরই

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো